সানি লিওন: নিজের ছায়া ছাপিয়ে এগিয়ে যাওয়া এক নাম।
একটি নাম – অসংখ্য পরিচয়। করনজিত কৌর ওহরা, যাকে আজ বিশ্ব সানি লিওন (Sunny Leone) নামে চেনে, তাঁর জীবনের প্রতিটি ধাপ এক একটি সাহসের গল্প। কানাডার এক শিখ পরিবারে জন্ম নিয়ে তিনি আজ বলিউডের আলোচিত অভিনেত্রী ও সমাজের পরিবর্তনের প্রতীক।
১৯৮১ সালের ১৩ মে কানাডার অন্টারিও শহরে জন্ম নেন সানি। তার পরিবার ছিল পাঞ্জাবি শিখ। ছোটবেলায় সানি ছিলেন খুবই শান্ত স্বভাবের এবং একজন সাধারণ ভারতীয় কন্যার মতোই লালিত-পালিত হয়েছেন। খেলার মাঠ থেকে পড়াশোনার পাঠশালা – সব জায়গাতেই তিনি ছিলেন মনোযোগী।
তরুণ বয়সে মডেলিং জগতে পা রাখেন করনজিত। এরপর কিছু সময়ের জন্য তিনি প্রাপ্তবয়স্ক চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করেন এবং সেখানে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। কিন্তু এখানেই থেমে থাকেননি তিনি।
তিনি নিজের পরিচয়কে ছাড়িয়ে যেতে চেয়েছিলেন। সাহস নিয়ে এগিয়ে গেছেন বলিউডে।
২০১২ সালে মাহেশ ভাট পরিচালিত "জিসম ২" চলচ্চিত্রের মাধ্যমে সানি লিওন বলিউডে আত্মপ্রকাশ করেন। এরপর "রাগিনি এমএমএস ২", "এক পহেলি লীলা", "মস্তিজাদে", "তেরা ইন্তেজার"– এর মতো একাধিক হিট সিনেমায় কাজ করেন।
তাঁর আইটেম সং ‘বেবি ডল’ আজও জনপ্রিয়তার শীর্ষে।
সানি লিওনের জীবনে ভালোবাসা আসে ড্যানিয়েল ওয়েবারের মাধ্যমে। ২০১১ সালে তাঁরা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। বর্তমানে তাঁদের তিন সন্তান রয়েছে – একটি দত্তক কন্যা নিশা এবং যমজ পুত্র নোয়াহ ও আশের।
সানি লিওন শুধু একজন অভিনেত্রী নন, বরং তিনি একটি দৃষ্টান্ত। সমাজের বহু কটাক্ষ, বিদ্রুপ এবং সমালোচনার সম্মুখীন হয়েও তিনি নিজের জীবন গড়ে তুলেছেন সাহস ও আত্মবিশ্বাস দিয়ে।
তিনি শিশু কল্যাণ, নারী স্বাধীনতা ও পশু সুরক্ষার কাজেও যুক্ত আছেন।
বলিউডে প্রবেশের সময় সানি লিওনকে ব্যাপক সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। তাঁর অতীত জীবন নিয়ে একাধিক বিতর্ক, মন্তব্য ও সংবাদ শিরোনামে উঠে এসেছিল।
কিন্তু তিনি কখনো নিজেকে গোপন করেননি, বরং গর্বের সঙ্গে নিজের অতীতকে গ্রহণ করেছেন। তার এই সাহসিকতা তাঁকে করে তোলে অনন্য।
“মানুষ আমাকে বিচার করেছে, কিন্তু আমি কখনো নিজের প্রতি বিশ্বাস হারাইনি।” — সানি লিওন।
সানি লিওন শুধু সিনেমাতেই সীমাবদ্ধ থাকেননি। তিনি বিভিন্ন রিয়্যালিটি শো-তেও অংশগ্রহণ করেছেন। ‘বিগ বস সিজন ৫’ ছিল তার জীবনের এক বড় মোড়। এই অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার পরই তিনি ভারতীয় দর্শকের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠেন।
পরবর্তীতে ‘স্প্লিট্সভিলা’র মতো জনপ্রিয় শো সঞ্চালন করে তিনি টিভি দুনিয়াতেও নিজের আলাদা জায়গা তৈরি করেন।
২০১৭ সালে মহারাষ্ট্রের লাতুর থেকে এক অনাথ কন্যা শিশুকে দত্তক নেন সানি ও ড্যানিয়েল, যার নাম রাখেন নিশা কৌর ওয়েবার। এর ঠিক এক বছর পর সারোগেসির মাধ্যমে যমজ পুত্র নোয়া ও আশার জন্ম হয়। একজন দায়িত্বশীল মা হিসেবে সানি লিওন তাঁর সন্তানের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার জন্য সব কিছু করছেন।
সানি লিওন আজ শুধুমাত্র একজন অভিনেত্রী নন, তিনি একজন সফল ব্যবসায়ীও। নিজের নামে কসমেটিক্স ব্র্যান্ড (Star Struck by Sunny Leone) চালু করেছেন, যা আজকের তরুণীদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়।
পাশাপাশি, পশু অধিকার সংস্থা PETA-র সঙ্গে যুক্ত থেকে প্রাণী কল্যাণের কাজও করে চলেছেন।
২০১৮ সালে সানি লিওনের জীবনের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল ওয়েব সিরিজ ‘Karenjit Kaur – The Untold Story of Sunny Leone’। এই সিরিজে তাঁর কঠিন সংগ্রামের কাহিনী, পারিবারিক টানাপোড়েন, সামাজিক চাপ ও সাহসিকতার গল্প বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়।
“আমি কখনো কারো অনুমতি চাইনি – আমি শুধু নিজের স্বপ্নের দিকে এগিয়ে গেছি।”
সানি লিওন তাঁর জীবন দিয়ে প্রমাণ করেছেন – "ভুলগুলোও জীবনের শিক্ষা হতে পারে।" তিনি আজ লক্ষ তরুণ-তরুণীর অনুপ্রেরণা, যাঁরা সামাজিক বাধা ও কুসংস্কারের মধ্যে দিয়ে নিজের জায়গা খুঁজে নিতে চায়।
সানি লিওন ভারতের মতো রক্ষণশীল সমাজে একটি সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তিনি জানতেন, তার অতীত নিয়ে অনেকেই আঙুল তুলবে। তবুও তিনি নিজেকে লুকিয়ে না রেখে, সত্যের মুখোমুখি হয়েছেন।
তিনি বিশ্বাস করেন –
“অন্যের বিচার আমাদের থামিয়ে দিতে পারে না। নিজেকে বিশ্বাস করলেই হয়।”
আজ তিনি নারীদের জন্য একটি বার্তা — যে কোনো পেশা বা সিদ্ধান্ত যদি নিজের ইচ্ছা থেকে হয়, তবে সেটা কখনো লজ্জার নয়।
সানি লিওনের জীবন অনেক নারীর চোখে সাহসের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে। তিনি কখনোই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের “ভদ্রতার” মোড়কে নিজেকে আড়াল করেননি। বরং বলেন—
“একজন নারী যদি নিজের শরীর, মতামত, সিদ্ধান্ত নিয়ে স্বাধীনভাবে বাঁচে, সেটাই আসল নারীত্ব।”
তিনি বারবার বুঝিয়ে দিয়েছেন, একজন নারী চাইলে নিজের অতীতকে ছাপিয়ে ভবিষ্যৎ নির্মাণ করতে পারে।
সানি লিওন এখন অভিনয়ের পাশাপাশি প্রযোজনাতেও মন দিচ্ছেন। তিনি ভবিষ্যতে নারী কেন্দ্রিক সিনেমা ও সিরিজ প্রযোজনা করতে চান, যেখানে সাহসী গল্প, নারীর অধিকার ও বাস্তব জীবনের সংগ্রাম উঠে আসবে।
এছাড়া তিনি নিজস্ব ব্র্যান্ড এবং ফ্যাশন লাইন নিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ করতে চাইছেন।
সানি শিশুদের স্বাস্থ্য, নারী শিক্ষা এবং পশু অধিকার নিয়ে বহু সমাজসেবামূলক কাজে যুক্ত। তিনি PETA India, Cancer Patients Aid Association, এবং Save The Girl Child উদ্যোগে সক্রিয়ভাবে কাজ করছেন।
তিনি বিশ্বাস করেন –
“যদি সাফল্য পেয়েই থাকি, তাহলে সমাজকে কিছু ফিরিয়ে দেওয়া আমার দায়িত্ব।”
সানি লিওনের জীবন থেকে শেখার মতো কিছু মূল বার্তা:
নিজেকে ভালোবাসুন, বিচার নয়।
সমাজ যা বলে তা শুনে নয়, নিজের হৃদয় শুনে চলুন।
ভুল হতেই পারে — সেটা মেনে নিয়ে সামনে এগোনোই আসল জীবন।
আত্মসম্মান হারালে সব হারিয়ে যায় – সেটাকে আঁকড়ে ধরুন।
সানি লিওনের গল্প কোনো গ্ল্যামার মাখানো সাফল্যের চিত্র নয়। এটা একজন নারীর আত্মনির্ভরতা, আত্মবিশ্বাস এবং আত্মমর্যাদার সংগ্রামের গল্প। আজ তিনি সমাজের চোখে শুধু একজন অভিনেত্রী নন — তিনি একজন বিপ্লবী নারী, একজন আদর্শ মা, একজন ব্যবসায়ী, এবং একজন অনুপ্রেরণার উৎস।
0 মন্তব্যসমূহ