কুলি : রাজনীতির ছোঁয়া, অ্যাকশনের ঝড়, কিন্তু প্রভাব কম!
দক্ষিণী সিনেমার সুপারস্টার রাজিনীকান্তের নতুন ছবি “Coolie” মুক্তি পাওয়ার পর থেকেই ভক্তমহলে উত্তেজনা তুঙ্গে। কারণ একটাই — এই ছবির পরিচালক লোকেশ কানাগারাজ, যিনি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে Kaithi, Master, Vikram–এর মতো ব্লকবাস্টার দিয়ে দর্শকদের মন জয় করেছেন। এবার তাঁর সঙ্গে রাজিনীর প্রথম সহযোগিতা, যা স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যাশার মাত্রা আকাশছোঁয়া করে দিয়েছিল।
কিন্তু, সব বড় নাম ও উঁচু প্রত্যাশার মাঝেও ছবিটি শেষ পর্যন্ত কিছুটা হতাশ করেছে। কারণ, গল্পে যত আইডিয়া আর সাবপ্লট ঢোকানো হয়েছে, সব একসাথে মিশে গিয়ে প্রয়োজনীয় আবেগীয় প্রভাব ফেলতে পারেনি। ফলে দর্শক একদিকে অ্যাকশন-ভরপুর দৃশ্য উপভোগ করলেও, গল্পের গভীরতায় অনেকটাই খামতি থেকে গেছে।
Coolie–এর গল্প ৯০-এর দশকের চেন্নাই শহরের প্রেক্ষাপটে দাঁড় করানো হয়েছে। এখানে রাজিনীকান্ত অভিনয় করেছেন “মুরুগান” নামের এক অভিজ্ঞ কুলি চরিত্রে, যিনি রেলস্টেশনে মাল বহন করে জীবিকা নির্বাহ করেন। কিন্তু তাঁর অতীত জীবনে লুকিয়ে আছে রহস্য, যা ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয়।
ছবির শুরুতেই দেখা যায় — সাধারণ কুলি হলেও মুরুগানের শারীরিক ক্ষমতা, বুদ্ধি আর নেতৃত্বগুণ অন্যদের থেকে আলাদা। শহরে যখন একটি বড় অপরাধচক্র রেলওয়ে করিডোর দখল করতে চায়, তখন মুরুগান নিজের মানুষদের রক্ষা করতে নেমে পড়েন এক অসম লড়াইয়ে।
এর মাঝেই ফ্ল্যাশব্যাকে উঠে আসে তাঁর অতীত — তিনি একসময় ছিলেন একজন ইউনিয়ন লিডার, যিনি রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রে ফেঁসে সবকিছু হারিয়েছেন। এই দুই টাইমলাইনের মধ্যে চলাফেরা করে গল্পটা এগোয়, যেখানে মুরুগানের ব্যক্তিগত ক্ষোভ, সামাজিক ন্যায়ের লড়াই এবং রাজনৈতিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর কাহিনী ফুটে ওঠে।
লোকেশ কানাগারাজের ছবি মানেই টানটান অ্যাকশন, বুদ্ধিদীপ্ত ডায়ালগ, আর ডার্ক কিন্তু রঙিন ভিজ্যুয়াল স্টাইল। Coolie–তেও তিনি সেই স্বাক্ষর রেখেছেন। কিন্তু বড় সমস্যা হয়েছে চিত্রনাট্যের ওজন নিয়ে।
এখানে অন্তত পাঁচটি বড় থিম একসাথে ঢোকানো হয়েছে —
কুলিদের জীবনসংগ্রাম
রাজনৈতিক দুর্নীতি
রেলওয়ে জমি দখলের মাফিয়া কাহিনী
মুরুগানের ব্যক্তিগত প্রতিশোধ
সামাজিক ন্যায় ও শ্রমিক ইউনিয়ন আন্দোলন
প্রতিটি থিম আলাদা ছবির গল্প হতে পারত, কিন্তু একসাথে এগুলোকে সামলাতে গিয়ে ফোকাস হারিয়েছে মূল কাহিনী। ফলে ক্লাইম্যাক্সে আবেগীয় আঘাত বা ‘পাঞ্চ’ সেভাবে কাজ করে না।
৭০–এর কোঠায় দাঁড়িয়েও রাজিনীকান্তের পর্দায় উপস্থিতি সত্যিই ম্যাজিকের মতো। তাঁর স্টাইল, ভঙ্গি, ডায়ালগ ডেলিভারি — সবকিছুতেই ভক্তরা হাততালি দেবেন। Coolie–তে তিনি কখনও সাদাসিধে শ্রমিক, কখনও লড়াকু নেতা, আবার কখনও অ্যাকশন হিরো।
তবে সমস্যাটা হলো, চিত্রনাট্যের অসংলগ্নতা তাঁর অভিনয়ের ধার কমিয়ে দিয়েছে। অনেক দৃশ্যে রাজিনীর চরিত্রকে শুধু স্টাইল দেখানোর জন্য ব্যবহার করা হয়েছে, যেখানে চরিত্রের আবেগ বা ভেতরের দ্বন্দ্ব আরও গভীরভাবে ফুটিয়ে তোলা যেত।
সৌবিন শহির: ভিলেন চরিত্রে তিনি চমকপ্রদ। তাঁর কণ্ঠের টোন, দৃষ্টি এবং ঠাণ্ডা মেজাজ ভিলেনিকে এক অন্য মাত্রা দিয়েছে।
প্রিয়া ভাবানি শংকর: সাংবাদিক চরিত্রে তিনি গল্পে তথ্য ও নৈতিকতার দিকটা তুলে ধরেছেন। কিন্তু তাঁর চরিত্রের আর্ক তাড়াহুড়ো করে শেষ করে দেওয়া হয়েছে।
শাইন টম চাকো ও অন্যান্যরা: গ্যাং সদস্যদের চরিত্রে ভালো কাজ করেছেন, তবে আলাদা করে মনে রাখার মতো কিছু নেই।
লোকেশের ছবির বড় শক্তি হলো অ্যাকশন। Coolie–তে রেলস্টেশনের ভেতরে, মালগাড়ির উপরে, গুদামঘরে — বিভিন্ন লোকেশনে দুর্দান্ত ফাইট সিকোয়েন্স রাখা হয়েছে।
স্টান্ট কোরিওগ্রাফি বাস্তবধর্মী হলেও রাজিনীর জন্য কয়েকটি ‘অতিমানবীয়’ মুহূর্ত রাখা হয়েছে, যা ভক্তরা উপভোগ করলেও সমালোচকেরা অবাস্তব বলে তকমা দেবেন।
সঙ্গীত পরিচালক অনিরুদ্ধ রবিচন্দ্রনের ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর টানটান উত্তেজনা তৈরি করে, তবে গানগুলো তেমন মনে দাগ কাটে না।
সিনেমাটোগ্রাফার গিরিশ গঙ্গাধরনের ক্যামেরা শহরের গলি, স্টেশন, ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোনকে রঙিন অথচ কড়া টোনে ফুটিয়ে তুলেছে।
প্রথম অর্ধেক ছবিতে গল্প এগোয় বেশ গতিতে, কিন্তু দ্বিতীয় অর্ধেক বিশেষ করে ফ্ল্যাশব্যাক অংশে গতি কমে যায়। ক্লাইম্যাক্স দীর্ঘায়িত হওয়ায় দর্শকের মনোযোগ খানিকটা ভেঙে যায়।
রাজিনীকান্তের স্টাইল ও উপস্থিতি
সৌবিন শহিরের ভিলেনি
বাস্তবধর্মী লোকেশন ও অ্যাকশন দৃশ্য
লোকেশের ভিজ্যুয়াল স্টাইল
অতিরিক্ত সাবপ্লট ও থিম
আবেগীয় গভীরতার অভাব
গানগুলোর দুর্বলতা
গতি ও সম্পাদনার অসামঞ্জস্য
Coolie এমন একটি ছবি, যা রাজিনীকান্তের ভক্তদের জন্য ভিজ্যুয়াল ট্রিট, কিন্তু সিনেমাটিকভাবে অসম্পূর্ণ। লোকেশ কানাগারাজ চেষ্টা করেছেন সামাজিক বার্তা, রাজনৈতিক থ্রিল, অ্যাকশন ও স্টাইল — সবকিছু এক ছবিতে গুঁজে দিতে। কিন্তু ‘অতিরিক্ত’ প্রয়াসই ছবিটিকে গন্তব্যে পৌঁছাতে দেয়নি।
যদি আপনি রাজিনীর স্টাইল, বড়সড় অ্যাকশন দৃশ্য এবং সিঙ্গেল-স্ক্রিন হলের হুইসেল-মোমেন্ট দেখতে চান, তাহলে Coolie আপনার ভালো লাগতে পারে। কিন্তু যদি আপনি একগাঁথা শক্তিশালী গল্প খুঁজে থাকেন, তাহলে হয়তো কিছুটা হতাশ হবেন।
0 মন্তব্যসমূহ