অত্যন্ত ভয়ঙ্কর মুহূর্ত সুখী টপে হড়পা বান ও মেঘভাঙা বৃষ্টির ধ্বংস।
উত্তরাখণ্ড আবারও প্রকৃতির রুদ্ররূপের সাক্ষী হল। ধারালির মেঘভাঙা বৃষ্টির রেশ কাটতে না কাটতেই উত্তরকাশীর আরেকটি জনপদ ‘সুখী টপ’-এ ঘটে গেল আরও একটি মর্মান্তিক ঘটনা। গতরাতে (৪ আগস্ট, ২০২৫), হঠাৎই মেঘভাঙা বৃষ্টি নামে এই পাহাড়ি এলাকায়। এরপর এক ভয়াবহ হড়পা বান বা ফ্ল্যাশ ফ্লাড গ্রাস করে স্থানীয় জনজীবন। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় একাংশ। ভেসে যায় ঘরবাড়ি, রাস্তা, গাড়ি এবং গবাদি পশু। এই ঘটনায় আতঙ্কের ছায়া নেমে এসেছে গোটা অঞ্চলে।
উত্তরকাশী জেলার অন্তর্গত সুখী টপ হল গাঙ্গোত্রী হাইওয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। এখান থেকে গাড়িচালকরা সাধারণত গাড়ি থামিয়ে হিমালয় দর্শন করেন, পর্যটকরাও এখানে বিশ্রাম নেন। কিন্তু গতরাতে আচমকাই রাত ২:৩০ নাগাদ শুরু হয় প্রবল মেঘভাঙা বৃষ্টি। এর ফলে পাহাড় থেকে প্রচুর পরিমাণে জল, কাদা ও পাথর গড়িয়ে নামে নিচু এলাকায়।
একটি ছোট্ট ঝোরা মুহূর্তের মধ্যে রূপ নেয় বিশাল এক জলপ্রবাহে, যা ভাসিয়ে নিয়ে যায় যা কিছু সামনে পড়ে।
ঘটনার কিছুক্ষণ পরেই সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয় কিছু সিসিটিভি ফুটেজ ও স্থানীয় বাসিন্দাদের মোবাইল ভিডিও, যেখানে দেখা যায় কীভাবে রাতের অন্ধকারে বিশাল জলের ধাক্কায় ভেসে যাচ্ছে দোকান, হোটেল ও গাড়ি। কিছু ভিডিওতে দেখা যায় মানুষ প্রাণভয়ে দৌড়চ্ছেন পাহাড়ের দিকে, কেউবা নিজ নিজ দোকান বা রেস্টুরেন্ট থেকে বেরোতে না পেরে ভিতরে আটকে পড়েছেন।
স্থানীয় বাসিন্দা হেমন্ত নেগি বলেন:
“আমরা ঘুমোচ্ছিলাম। হঠাৎ এক বিকট শব্দে ঘুম ভাঙে। জানলা খুলেই দেখি রাস্তা গায়ে গায়ে জল আর পাথরের স্রোত, একটা বড় গাড়ি আমাদের হোটেলের পাশ দিয়ে ভেসে যাচ্ছে।”
প্রাথমিক সূত্রে জানা গিয়েছে:
৫ জন নিখোঁজ, যাঁদের সন্ধান এখনও পাওয়া যায়নি।
৩ জন গুরুতর আহত, তাঁদের উত্তরকাশী জেলা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
১২টির বেশি দোকান ও হোটেল সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়েছে।
২০টির বেশি গাড়ি ও বাইক ভেসে গিয়েছে অথবা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
গবাদি পশুর মৃত্যুও ঘটেছে, বহু কৃষকের ক্ষতি।
মেঘভাঙার খবর পাওয়া মাত্রই প্রশাসনের তরফে এনডিআরএফ (NDRF), পুলিশ ও দমকল কর্মীদের পাঠানো হয় এলাকায়। রাস্তা বন্ধ থাকায় হেলিকপ্টার ও ড্রোন ব্যবহার করে উদ্ধার কাজ শুরু করা হয়েছে।
উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর সিং ধামী টুইট করে জানান:
“উত্তরকাশীর সুখী টপ-এ প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য রাজ্য সরকার সম্পূর্ণ পাশে আছে। উদ্ধার ও ত্রাণকার্য দ্রুত চলছে। ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য জরুরি তহবিল থেকে সাহায্য বরাদ্দ করা হয়েছে।”
সুখী টপ অঞ্চলে মাটিধস ও রাস্তা ধসে যাওয়ায় গাঙ্গোত্রী হাইওয়ে পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ফলে গঙ্গোত্রীধামে যাওয়া বহু তীর্থযাত্রী মাঝপথে আটকে পড়েছেন। তাঁদের জন্য অস্থায়ী ক্যাম্প ও খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
গত কয়েক বছরে উত্তরাখণ্ডে এভাবে মেঘভাঙা ও হড়পা বান একাধিকবার ঘটেছে। ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে একইরকম ভাবে রুদ্রপ্রয়াগ ও কেদারনাথে হড়পা বান হয়ে বহু প্রাণহানি ঘটে। বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তন ও অপরিকল্পিত নির্মাণই এর অন্যতম কারণ।
সুখী টপ এলাকার বহু বাসিন্দার অভিযোগ, প্রশাসন আগে থেকে কোনও সতর্কতা দেয়নি। মেঘভাঙার কোনও পূর্বাভাস ছিল না। তাঁরা আরও বলেন যে, গত কয়েক বছরে এখানে পর্যটন ও নির্মাণের চাপ অত্যধিক বেড়েছে, যার ফলে প্রকৃতি তার ভার বহন করতে পারছে না।
স্থানীয় সমাজকর্মী দীপা বত্সাল বলেন:
“হোটেল, দোকান, পার্কিং লট তৈরি হচ্ছে ঝোরা ও পাহাড়ি নালার উপরে। বর্ষাকালে এই জলনালাগুলিই হড়পা বান সৃষ্টি করে। আমাদের বারবার আবেদন সত্ত্বেও কেউ শোনেনি।”
অত্যন্ত দুর্গম এলাকা হওয়ায় উদ্ধারকারীদের কাজও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাথর, গাছের গুঁড়ি, গাড়ির ধ্বংসাবশেষ সরাতে সময় লাগছে। রাতে পরিষ্কার আলো না থাকায় ড্রোন ও হ্যান্ডল্যাম্পের সাহায্যে উদ্ধার চলেছে।
NDRF কমান্ডার জানান:
“আমরা জীবিতদের খোঁজে এখনও অভিযান চালাচ্ছি। কেউ যদি ধ্বংসস্তূপে আটকে পড়ে থাকেন, তাঁকে বাঁচানোর সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে।”
পর্বত বিশেষজ্ঞ ও হিমালয় গবেষক ডঃ অনিরুদ্ধ বর্মন বলেন:
“উত্তরকাশী, চামোলি, রুদ্রপ্রয়াগ ইত্যাদি অঞ্চলগুলো এখন জলবায়ু পরিবর্তনের গুরুতর প্রভাব দেখছে। অল্প সময়ে অত্যধিক বৃষ্টি মাটির ধরন বদলে দিচ্ছে। সেই সঙ্গে গাছ কাটা, রাস্তা কাটা, টানেল নির্মাণ – এগুলিও ভূমিধস বাড়াচ্ছে।”
রাজ্য সরকারের তরফে ঘোষিত হয়েছে:
নিখোঁজদের পরিবারকে ₹৫ লক্ষ করে ক্ষতিপূরণ
আহতদের চিকিৎসা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে
ধ্বংসপ্রাপ্ত দোকান মালিকদের জন্য বিশেষ পুনর্বাসন প্যাকেজ
ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তা ও বিদ্যুৎ ব্যবস্থা পুনরুদ্ধারে জরুরি প্রকল্প শুরু
সুখী টপে যা ঘটেছে, তা কেবল একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়—এ এক সতর্ক সংকেত। পাহাড়ে বসবাস ও পর্যটনের ভারসাম্য বজায় না রাখতে পারলে এ ধরনের দুর্যোগ ভবিষ্যতেও ঘটতেই থাকবে। প্রাণ, সম্পদ এবং পরিবেশ—সবই হারাতে হবে বারবার।
এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পর আমরা কি কিছু শিখব? নাকি আবারও এই দুঃস্বপ্ন ফিরে আসবে অন্য কোনো সুখী টপে?
মেঘভাঙার ঠিক মুহূর্তে ক্যামেরাবন্দী হড়পা বান
ধ্বংসস্তূপে পরিণত দোকানপাট
উদ্ধারকার্যরত NDRF সদস্যরা
ভয়ে কাঁপতে থাকা শিশুসহ পরিবার
আপনি যদি এই অঞ্চলে থাকেন বা আপনার পরিচিত কেউ থাকেন, অনুগ্রহ করে সতর্ক থাকুন। আবহাওয়ার আপডেট দেখুন এবং ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে যাবেন না। উদ্ধার ও ত্রাণকর্মীদের সাহায্য করতে হলে প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।
এই ঘটনার প্রতি আমাদের গভীর সহানুভূতি রইল। ঈশ্বর যেন সব ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে সহ্যশক্তি দেন।
0 মন্তব্যসমূহ